
স্ত্রী ভয়ংকরী
আমার ছোট বেলার বন্ধু আজাদ!
স্কুল থেকে শুরু করে ঢাকা কলেজ অবধি একসাথে পড়াশোনা করেছি! হঠাৎ একদিন সিদ্ধেশ্বরীতে ওর সাথে দেখা!
তুই আজাদ না?
হ্যাঁ তুই বাচ্চু-ঠিক ধরেছি বল!
একদম ঠিক! একি দশা হয়েছে তোর! কঠিন ব্যামো?
আরে না ওসব কিছুনা! চল একটু চা খাই!
চল!
চা খেতে খেতে দুষ্টুমির ছলে মনে করিয়ে দিলাম ঢাকা কলেজে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে ইডেনের গেটে-চাতকের মত দাঁড়িয়ে থাকতি যার জন্য সেই মুন্নী এখন কোথায়?
আজাদ ব্যথাতুর নয়নে আমার পানে চাইল,'তোর মনে আছে'?
লেডী কিলার ছিলি তুই!
কিলারটা আর নেইরে-নিজেই লেডী হয়ে গেছি!
আমরা দু'জন হাঁটছি-বেইলী রোড ধরে হাঁটছি! ও আমার হাত এমন ভাবে ধরে আছে যেন হাত ছাড়লেই আমি দৌঁড়ে পালিয়ে যাব!
ভয় পাসনে-ধার চাইবনা! ও বলল! আমি আহত হলাম! ওকে আমি ছোট বেলায় খুব পছন্দ করতাম-এখনো!
আমরা হেঁটে হেঁটে সার্কিট হাউজ মসজিদ পার হয়ে কাকরাইল জামে মসজিদ লাগোয়া পকেট গেইটটি দিয়ে রমনা পার্কে ঢুকলাম!
শরতের প্রখর রোদ! থেমে থেমে হাল্কা বাতাস বইছে! আজাদকে ছেড়ে যেতে মন চাইছেনা!
একটা বেঞ্চিতে দুই বন্ধুতে বসলাম-ঠিক চল্লিশ বছর আগে ঢাকা কলেজের ১নং গ্যালরীতে যেভাবে বসতাম! অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ক্লাশ করছি যেন! মজা করে বাংলা পড়াতেন! সেই যে রবীন্দ্র,নজরুল,শরৎ,তারাশঙ্কর,মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রেমে পড়লাম এই প্রেমের খেসারত দিচ্ছি আজীবন! আকন্ঠ আবেগ আমাকে বাস্তববাদী হতে দেয়নি!
আজাদের ঘাড়ে কি একটা গভীর ক্ষত! অতি সাম্প্রতিক ক্ষতযে এতে কোন সন্দেহ নাই!
আজাদ তোর ঘাড়ে ওটা কিসের দাগ?
আজাদের চোখ জলে টলমল!
কিছু বলছিস না যে!
ওরা আমায় মারে--প্রায়প্রায়ই মারে!
ওরা কারা? কেন?
তোর ভাবী আর ওরা দু'ভাইবোন?
উফঃ বলিস কি-কেন?
মুন্নীর সাথে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাতো জানিসই--!
চিঠি চালাচালিও চলছিল বেশ!
শেষতক ওর বাবা বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিতে রাজী হলেন না!
মেয়েকে এক আমেরিকা প্রবাসী ড্রাইভারের কাছে বিয়ে দিলেন!
ড্রাইভার শালা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেল!
আমি কি নিয়ে থাকি? আমাকে লেখা ওর চিঠিগুলো সযত্নে রেখে দিলাম নিজের কাছে!
এরই মধ্যে আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি শুরু করলাম-বেসরকারি চাকরী!
বিয়ে করে সংসারী হলাম-কিন্তু সারাক্ষন মনের মধ্যে সেই মুন্নী!
রাতে মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে মুন্নীর চিঠি পড়ি! খোদার কসম এর বেশি কিছুনা! মুন্নী হয়তো আমাকে মনেও রাখেনি!
আর খুব মৃদুস্বরে গাই,"কাভি কাভি মেরে দিলমে খেয়াল আতা হ্যায়"!
কপাল মন্দ হলে যা হয়! একদিন তোর ভাবির কাছে 'কট' হয়ে গেলাম!
আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহবল হয়ে পড়লাম!
থতমত খাচ্ছি-প্রচন্ড শীতেও ঘামছিলাম! ও আমার চুলের জুলফি ধরে দুই গালে প্রচন্ড জোরে দু'টো চড় মারল!
পাশের রুম থেকে আমার ক্লাশ সেভেন পড়ুয়া পুত্র আর পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ুয়া কন্যাটি বেরিয়ে এল!
ওদের মা চিৎকার করে বলছে,হলুদ বাটো,মেন্দি বাটো তোমাদের নতুন মা আসছে!
তোমাদের লুইচ্চা বাবা তলে তলে পরকীয়া করছে--! ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কি!
আমি মিন মিন করে বল্লাম-রেনু কাজট কি ঠিক হলো?
-চুউপ শুয়োরের বাচ্চা!
-রেনু প্লিজ! ছেলে মেয়েরা শুনছে!
-শুনুক !তোর লুইচ্চামো পাড়া পড়শি সবাই শুনুক!
-রেনু প্লিজ!তুই তোকারি করোনা!
-ওরে? আবার কি বলেরে?
আমি যত আস্তে বলি ও ততই গলা চড়ায়! শেষমেষ আমি রণে ভঙ্গ দিলাম!
কি এক বিচ্ছিরি অবস্থায় পড়েছি-কাউকে বলে বুঝাতে পারছিনা!
অবস্থা এমন হলো যে আমার চলাফেরা কথা বলা এমন কি খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল! রাতে শোয়ার আগে একটা সিগারেট খাওয়া আমার বহুদিনের অভ্যেস! সেই অভ্যেসেরও রাশ টেনে ধরা হল!
অফিস থেকে ফিরলেই রেনু ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে নেয়---শুরু হয় গভীর রাত অবধি মোবাইলের পোষ্টমর্টেম!
অবস্থা এমন বেগতিক দাঁড়িয়েছে যে গ্রামে মাতৃসম বিধবা ভাবিটার সাথেও চোরের মত যোগাযোগ করতে হয়!
আমার বড় ভাই মারা যাবার পর এই ভাবিই তার চার সন্তানের সাথে আমাকেও মাতৃস্নেহে মানুষ করেন! সেই ভাবিকে নিয়েও আজে বাজে কথা বলা শুরু হলো!
এতিম ভাতিজাগুলোর পড়াশোনার জন্য যৎসামান্য খরচও পাঠাতে পারিনা-রেনু চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে-
-আমারতো মনে হয় ভাবির সঙ্গে তোর অবৈধ সম্পর্ক আছে! পোলাপান গুলোর আসল বাপতো তুই-ই! জাউরার ঘরের জাউরা!
সেদিন আর সহ্য হলোনা! রাগের মাথায় ওকে একটা চড় বসিয়ে দিলাম!
আর যায় কোথায়!
ও আমারে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে লাগল! আমি সামাল দিতে না পেরে সাহায্য চেয়ে চিৎকার করছি!
আমার একমাত্র কন্যা আমার মুখ চেপে ধরল! পাছে ওদের মান সম্মান যায়!
এক পর্যায়ে পিছন ফিরে দেখি আমার সপ্তম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত একমাত্র ছেলে আমাকে রুটি তৈরির বেলন দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে!
আমি এতিমের মত চোখের জল ফেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম!
সে রাতে রেনু আমাকে বিছানায় উঠতে দিলনা!
-শুয়োরের বাচ্চা তুই নিচে ঘুমাবি!
আমি ভাল ছেলের মত ওর আদেশ মেনে নিলাম !
কাক ডাকা ভোরে ওঠে রেনু তার বাপের বাড়ি কুমিল্লা চলে গেল!
ছেলে মেয়ের পড়াশুনা চাঙ্গে উঠল!ওদের ভবিষ্যত আমার জন্য অন্ধকার হোক তা আমি চাইছিলাম না!
আমি রেনুকে ফিরিয়ে আনতে গেলাম! ও ফিরলনা! অকস্মাৎ একদিন রেনু ওর এক উকিল মামাকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরল-এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমার বাড়ি,আশুলিয়ার জমি সাব-রেজিষ্ট্রারকে কমিশনিং করে নিজ নামে লিখে নিল!ব্যাঙ্কের সঞ্চয়পত্রগুলো মেয়াদপূর্তির পুর্বেই ভেঙ্গে ফেলে ওর নামে করে দিতে বাধ্য করল!
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম!ছেলে মেয়ের সুখের জন্য এর বিকল্পও আমার ছিলনা!
হায় রেনু-আমার রেনু! লঘুপাপে গুরুদণ্ড আর কাকে বলে!এর সাথে একছাদের নিচে ছিলাম এতটা কাল?
বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে এখন বাড়িতে ঢুকি! আমার সাধের 'হাফডান' দু'তলা বাড়ির চিলেকোঠায় আমার রাত কাটে!
যেদিন ও বেশি যন্ত্রনা করে সেদিন মসজিদে রাত কাটাই-আজাদ বলছে!ওর চোখ জলে ছল ছল !
আমি আজাদের হাত দু'টি নিজের হাতে তুলে নিলাম! ওর দিকে তাকিয়ে গভীর বেদনা অনুভব করলাম!
তার অন্তরের ভিতর অস্ফুট স্বরে কে যেন গেয়ে উঠল,"আমিতো ভালানা-ভালা লইয়াই থাইকো"!
আপনার মন্তব্য লিখুন