
স্পাই স্টোরিজ
পৃথিবীর ইতিহাসে গুপ্তচরবৃত্তি নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রাচীন কাল থেকেই এটা প্রচলিত। বর্তমান বিশ্বেও সিআইএ, মোসাদের মতো রাষ্ট্রীয় গুপ্তচরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে৷
এই বইটিতে ছয়টি শ্বাসরুদ্ধকর সত্যি ঘটনা আছে। এগুলো পড়ার সময় রাশিয়া, আমেরিকা, লিবিয়া, মিশর, ইসরায়েল, কিউবা থেকে কল্পনার পাখা মেলে ঘুরে এসেছি।
★অ্যাডলফ তেলকোচভ : বিলিয়ন ডলার স্পাই
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ শৈশবে চোখের সামনে জার্মান বিমানকাহিনীর বোমা হামলায় নিজের জন্মভূমিকে বিধ্বস্ত হতে দেখেন৷ ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করে যোগ দেন সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর রেডিও ইঞ্জিনিয়ারিং- এ। এই প্রতিষ্ঠান রাডার এবং ওয়েপন্স গাইডেন্স সিস্টেমসহ মিলিটারি গ্রেডের অস্ত্র নির্মাণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এখানেই পরিচয় হয় নাতাশা কাজমিন নামের এক তরুণীর সাথে। নাতাশার জীবনেও আছে এক দুর্বিষহ ইতিহাস।
বিয়ের বহু বছর পর দুইজন রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট বিজ্ঞানী শাখারভ ও ঔপন্যাসিক আলোক্সন্ডার সোলঝেনিৎসিন- এর সংস্পর্শে আসেন - যারা সোভিয়েত জনগণের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন৷ এই দুইজনের সংস্পর্শে তার মনোজগতের পরিবর্তন তাকে দেশ বিরোধী কাজে অনুপ্রেরণা দেয়৷ যোগ দেন সিআই-র এজেন্ট হিসেবে। তারপর সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বিবরণ।
★ ব্রায়ান রিগ্যান : যে স্পাই বানান করতে জানত না
এটা এক অদ্ভুত কাহিনি। ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত রিগ্যান হাইস্কুল শেষ করে যোগ দেন বিমানবাহিনীর সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগে। পরে তিনি বদলি হন ন্যাশনাল রিকনিসন্স অফিসে, যেটা সারা পৃথিবীতে আমেরিকার স্পাই স্যাটেলাইটের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের বিমানবাহিনীর অধীনস্থ গোয়েন্দা সংস্থা। এখানে যোগ দিয়ে তিনি লিবিয়া, ইরাক৷ ইরান, সুদান এবং চীনের কাজে লাগবে এমন তথ্য আর ছবি সংগ্রহ শুরু করেন। তথ্য সংগ্রহ করার উপায়ও অভিনব। খুব গোপনে সাংকেতিক ভাষায় এগুলো লিপিবদ্ধ করেন। তারপর যোগাযোগ করা শুরু করেন বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে।
এরপর কি হলো?
★ এজেন্ট স্টর্ম : যে স্পাই আওলাকিকে ধরিয়ে দিয়েছিল
আল কায়েদার নেতা আনোয়ার আল আওলাকি জন্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তার বাবা ইয়েমেনের নাগরিক। তিনি কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিএসসি ডিগ্রি নেন। চাকরীর পাশাপাশি তিনি স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করতেন৷ কিন্তু ৯/১১- এর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তিনি এই সন্ত্রাসী হামলার প্রচণ্ড সমালোচক ছিলেন। আমেরিকার ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ আওলাকির আদর্শিক অবস্থান পাল্টে যায়। এরমধ্যে এফবিআই'র হয়রানি, মাঝেমধ্যে তুলে নিয়ে যাওয়া, মসজিদে আসা মুসল্লিদের গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। আমেরিকার এমন নিরাপত্তাহীনতায় তিনি ইংল্যান্ডে চলে যায়। ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করলে তিনি আমেরিকাকে মুসলমানদের প্রধান শত্রু বলে অভিহিত করেন। এই সময়ে তিনি মুসলিম তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে জিহাদি লেকচার দেয়া শুরু করেন। তার লেকচারগুলো প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ইয়েমেনে শিক্ষকতা পেশায় থাকার সময় তিনি গ্রেফতার হন। বাবার চেষ্টায় ছাড়া পেয়ে তিনি আত্মগোপন করেন। সেখান থেকে যোগাযোগ করেন মরেন স্টর্মের সাথে। নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য চমৎকার ইংরেজি জানা কোনো তরুণীকে তিনি বিয়ে করতে চান৷
কিন্তু আওলাকি জানতেন না তিনি কি দূর্ভোগ ডেকে এনেছেন।
★ শুলা কোহেন : বৈরুতে ইসরায়েলি মাতাহারি
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসের আংশিক আখ্যান। জাতিসংঘের অধিবেশনে পাশ হয় ফিলিস্তিনে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ৪৫ শতাংশ আর ক্ষুদ্র ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ৫৫ শতাংশ ভূমি।
বৈরুতের ইহুদি কোয়ার্টারের স্কুল শিক্ষিকা, বিশিষ্ট সমাজসেবী, রূপবতী নারী শুলা কোহেন। স্বামী জোসেফের সাথে বৈরুত শহরেই থাকেন৷ পরিবার থেকে জায়নবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত শোলা কোহেন ছিলেন স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষপাতী। বৈরুতে থেকেই তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ইহুদিদের সীমান্ত পার করে ইসরায়েলে পৌঁছে দিতেন।
জেরুজালেমের জুইশ কাউন্সিলের সাথে যোগাযোগ, ইহুদিদের স্থানান্তর থেকে ধরা পড়া পর্যন্ত টানটান উত্তেজনার থ্রিলারকেও হার মানিয়ে যায়।
★ আশরাফ মারোয়ান : মোসাদের মিশরীয় এঞ্জেল
বিশ্বব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত গোয়েন্দা সংস্থার নাম মোসাদ। আর এই মোসাদের এজেন্ট ছিল আশরাফ মারোয়ান, যার সাংকেতিক নাম এঞ্জেল। যার গুপ্ত তথ্যের কারণের মিশর আর সিরিয়ার যৌথ উদ্যোগে ইসরায়েলের উপর অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। মিশরের এই আশরাফ মারোয়ান ছিলেন তৎকালীন মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের মেয়ে মুনা নাসেরের স্বামী৷ বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ে হয় আশরাফ আর মুনার।
খোদ প্রেসিডেন্ট জামাতা, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সিনিয়র উপদেষ্টা হয়ে যান মোসাদের এজেন্ট। অবাক করার মতো বিষয়।
কিন্তু কি ঘটে মারোয়ানের জীবনে?
★ আনা মন্টেজ : যে স্পাই কিউবাকে ভালোবেসেছিল
আমেরিকা আর সমাজতান্ত্রিক কিউবার দ্বন্দ্ব পুরনো বিষয়। সেই আমেরিকার প্রতিরক্ষাবিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থার সিনিয়র অ্যানালিস্ট আনা মন্টেজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেন খোদ আমেরিকার বিরুদ্ধে কিউবার হয়ে। এবং সেটা কোনো প্রাপ্তির আশায় নয় অনেকটা স্বেচ্ছাসেবীর মতো। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অফিসার স্কট কারমাইকেলের কাছে এটা অবিশ্বাস্য।
কেন আনা এই পথে পা বাড়ালো? সেটা এক আশ্চর্য কাহিনী।
বইটার নাম দেখো প্রথম প্রথম ভাবতাম - এটা বুঝি থ্রিলার। অবাক হতাম, এই লেখক কেন থ্রিলার লিখতে গেলেন? তবে এটা ফিকশন থ্রিলার নয়৷ বাস্তব জগতের সত্যি ঘটনা নিয়ে অবিশ্বাস্য থ্রিলার ঘটনা। একজন স্পাই কত গুরত্বপূর্ণ কাজ করেও শত্রু-মিত্র উভয়পক্ষের কাছেই অপাংক্তেয়। কি নিদারুণ বিষয়!
একটা বই পড়ে কত দেশের অজানা কাহিনী, পররাষ্ট্রনীতি, ব্যক্তি জীবনের কথা, সেই সময়র রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি জানা যায় তারই উদাহরণ এই বইটা। প্রতিটা রচনার পরে রেফারেন্স তালিকা দিয়ে লেখক অসাধারণ কাজ করেছেন৷
প্রথমে ভেবেছিলাম, লেখক বিদেশে পড়াশোনা করেন হয়তো তার শব্দ চয়ন, বর্ণনাভঙ্গি নিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে। কিন্তু অবাক করা বিষয়, লেখক চমৎকার গদ্যে লিখেছেন এই বইটি।
আমার ব্যক্তিগত একটা বিষয় আছে, বই পড়ার পর নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরে৷ এই বইটা পড়ার পর লেখকের কাছে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। খুব সুন্দরভাবে উত্তর পেয়েছি।
যে বই আমাকে অজানাকে চোখের সামনে হাজির করে, প্রশ্ন আর চিন্তা হাজির করে। নিসন্দেহে সেই বই আমার প্রিয়। গত বছর আমার পড়া সেরা বইয়ের একটা "স্পাই স্টোরিজ"।
বই : স্পাই স্টোরিজ
লেখক : মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা ( Mozammel Hossain Toha)
প্রচ্ছদ : তন্ময় ইরতিজা আঞ্জুম
প্রকাশনী : স্বরে অ
প্রকাশকাল : ২০২০
মুদ্রিত মূল্য : ২৭০ টাকা
আপনার মন্তব্য লিখুন