
মা, মা, মা এবং বাবা
মা, মা, মা এবং বাবা
সম্পাদনা: আরিফ আজাদ
প্রকাশনা: সমকালীন প্রকাশন
Don't judge a book by its cover কথাটি আমার কাছে অমূলক মনে হয়েছে এই বইটি পছন্দের ক্ষেত্রে।শুধু মাত্র বইটির প্রচ্ছদ আর নাম দেখে তখনই মনে হয়েছিল বইটি আমি সংগ্রহ করবো।বইটি সংগ্রহ করে সিএনজিতে ওঠার পরই আমার পাশের অপরিচিত ভদ্রলোক অতি আন্তরিকতার সাথে আমার কাছ থেকে বইটি চেয়ে নিল।তিনি কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বইটি দেখে বললেন যেভাবেই হোক এই বইটি আমিও সংগ্রহ করবো,তার এমন আগ্রহ সত্যি আমাকে আনন্দিত করেছে।
#মূল_আলোচনা : বইটি খোলার পর প্রথম পৃষ্ঠায়ই চোখে পড়ে একটি আয়াত - নিত্য পাঠের একটি দোয়া যা প্রতিটি সন্তানের কাছ থেকে তার পিতা মাতার প্রাপ্য।➡
"হে আমার রব,তাদের প্রতি সেভাবে দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন -পালন করেছেন।"
তারপরেই আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আঃ এর একটি হাদিস যেখানে উত্তম আচরণের হকদারের ক্ষেত্রে তিনবার মা কথাটি বলা হয়েছে চতুর্থবারে বাবার কথা বলা হয়েছে। সেখান থেকেই বইটির নামকরণ হয়েছে মা, মা,মা
এবং
বাবা।
বইটির সূচিপত্র দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমাংশে' জীবন থেকে নেওয়া' শিরোনামে পিতা-মাতা ও সন্তানদের যাপিত জীবনের ৩৫ টি হৃদয়স্পর্শী গল্পের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে। সূচিতে প্রতিটা গল্পের শিরোনামই আমাকে মুগ্ধ করেছে, মনে হয়েছে কখন সবগুলো গল্প শেষ করব।
প্রথম গল্পটি "মায়ের চিঠি" যেখানে খোকার কাছে তার মায়ের মায়া ভরা চিঠি।চিঠিটা পড়ার সময় যে কারো সামনে তার প্রিয় মায়ের মুখ ভেসে উঠবে,জন্মের পূর্ব থেকে শুরু করে বড় হওয়া পর্যন্ত একজন মা ❤সন্তানের জন্য যা কিছু করে তা চোখের সামনে ভেসে উঠবে।মায়ের জন্য এক অন্য রকম আবেগ ভালোবাসা চলে আসবে ঠিক তখনই।
তারপরের গল্প "সালেম" শিরোনামে লেখা হয়েছে। যেখানে সালেম এক ছোট্ট শিশুর নাম। যে শিশুটির বাবা ছিলেন পথভ্রুষ্ট।সালেমের জন্মের পূর্বে তিনি বিনা অপরাধে এক অন্ধ বৃদ্ধকে পা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। হাসপাতালে দেখলো তারই পুত্র অন্ধ জন্ম লাভ করেছে সেই সাথে সালেম হাঁটা চলায় অচল ছিল বড় হওয়ার পরই সঙ্গী হল হুইল চেয়্যার।অন্ধ প্রতিবন্ধী সালেম হয়ে যায় তার বাবার অবজ্ঞার পাত্র।অন্য সন্তানদের মতো তাকে কখনো ভালোবাসে না।একটা সময় অন্ধ সালেমের নামাজে দেরি হওয়ার জন্য কান্না আর মসজিদে গিয়ে সালেমের নামাজ আদায় ও কুরআন তেলওয়াত তার বাবাকে পরিবর্তন করে।নিজের হাজারো অপরাধ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।ইসলামের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে দূরে কোথাও যায়, কাজ শেষে বাড়িতে এসেই সালেম কে খুঁজতে ছিলেন।কিন্তু ততদিনে সালেম জান্নাতের মেহমান হয়ে গেছে।
তৃতীয় গল্পটি "বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসুন" গল্পটি কোনো এক হতভাগ্য অধম সন্তানের যে তার মা'কে একাকী ফেলে রেখে গেছে একটা চিরকুট সমেত।অপেক্ষমান মা অজ্ঞাত ছিল যে তারই অকৃতজ্ঞ হৃদয়হীন সন্তান চিঠিতে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার কথা লিখে রেখেছে।
এভাবেই একের পর এক বাস্তব ধর্মী গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে। এরপরে হৃদয় ছুঁয়েছে যে গল্পটি "রেস্টুরেন্টে একদিন" যেখানে এক আদর্শ ছেলে তার বাবাকে রেস্টুরেন্ট নিয়ে যত্ন করে খাওয়াচ্ছে, খাবার পরে যাওয়া বা কোনো কিছুতেই তার আপত্তি নেই। কিছু লোক তাকে দেখে শিক্ষা নিয়েছিল যে কিভাবে পিতা-মাতার শখ, আহ্লাদকে প্রাধান্য দিতে হবে।
"মায়ের মিথ্যে বলা " গল্পটি পড়ে অনুভূত হয় আমাদের মায়েরাও তাদের কত প্রয়োজন ত্যাগ করে গোপন রেখে বলে আমার লাগবেনা, আমি খেয়েছি। সন্তানকে সর্বস্ব ত্যাগ করে দিতেও মায়েরা সদা প্রস্তুত।
"মাকে পাওয়ার মামলা " গল্পটি সবার জীবনে বাস্তবিক হলে হয়তো কোনোদিন বৃদ্ধাশ্রম তৈরীর প্রয়োজন হতো না।গল্পটি আমার অনেক ভালো লেগেছে।তারপরই "আত্মত্যাগ " গল্পটি যুবক সমাজকে অনুপ্রাণিত করবে বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনে।
উপলব্ধির গল্প:আর কি পাবো তারে! কিছু স্মৃতি, কিছু শূন্যতা।আনুগত্যের গল্প :সঠিক পথের দিশা গল্পগুলো যেন এক একটা অনুপ্রেরণার উৎস।
'ফযল বিন ইয়াহ্ইয়া',সেতুবন্ধন,মৃত্যু থেকে শিক্ষা, বাবা মায়ের স্মৃতি গল্পগুলো পড়ে জানা যাবে মা বাবার প্রতি ঠিক কতটা আন্তরিক হতে হবে।
শোচনীয় পরিণতি, ধনী লোকের মানহানি,অবাধ্যতা,লোভের তাড়না, অবহেলা পড়ার পর খুবই আফসুস হবে মানুষের অজ্ঞতার জন্য,মা বাবার প্রতি গুরুত্বহীনতার শেষ পরিনতি যে সুখকর মঙ্গলময় নয় তা প্রকাশ পেয়েছে এই গল্পগুলোতে।
এরপরই 'সিলাহ রেহমি' মানে আত্মীয় -স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার এই প্রথাকে ইসলামে 'সিলাহ রেহমি'বলে।'সিলাহ রেহমি' টপিকটি এতোটা চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ হয়েছে যেখান থেকে জানা যাবে বড়দের কী বলে সম্বোধন করতে হবে।বড় হওয়ার পর মায়ের আলমারিতে খাবার কিনে রাখতে হবে,মা বাবার প্রশংসা করতে হবে।কেন বাবা মায়ের সামনে অহেতুক স্ত্রীর প্রশংসা করা যাবে না।শোক সংবাদ পেলে বাবা মাকে কিভাবে জানাতে হবে?সন্তানের সদাচরণ বাবা-মাকে যতটা আনন্দ দেয় ততটা অন্য কিছুই দেয় না তাই সকল মুহূর্তে বাবা মায়ের সাথে সর্বোত্তম আচরণ করতে হবে।এতে পিতা -মাতা যেমন খুশি হবেন আল্লাহও তেমনই খুশি হবেন।
#দ্বিতীয় পর্বের নাম কুর'আন ও হাদিস থেকে নেওয়া
সেখানে প্রথমেই দেওয়া হয়েছে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর নম্রতা।তাঁর মূর্তিপূজক বাবার সাথে শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত তিনি বিনয়ী আচরণ করেছেন।
তারপর জুরাইজের ঘটনায় মায়ের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।সেই সাথে আরও বুঝা যায় যে, নফল সালাতের চেয়ে মায়ের অধিকারের গুরুত্ব বেশি।
'উমার এর কান্না, পাথর অপসারণ বাবা -মায়ের দু'আ, উত্তম আচরণ ও সম্মান পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
দীর্ঘায়ু ও সম্পদ লাভ শিরোনামে বলা হয়েছে রাসুল সাল্লাল্লাহু (আঃ)এর হাদিস ➡
'যে ব্যক্তি দীর্ঘায়ু ও রিযক বৃদ্ধির আশা করে, সে যেন পিতা-মাতার আনুগত্য করে এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে'।
বইটি শেষ হয়েছে এক ইয়েমেনীয় ঘটনার মাধ্যমে যেখানে ইয়েমেনী যুবক মাকে পিঠে নিয়ে দীর্ঘ সময়(মায়ের গর্ভকালীন সময়ের থেকেও বেশি সময়) বহন করেই ভেবেছিল মায়ের প্রতিদান দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে উমার বলেছেন " মা বাবার প্রতিদান কোনোদিনই দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।"
যে আয়াতটি দিয়ে বইটি শেষ করা হয়েছে, প্রকাশকের কথাসহ বারবার বইয়ের মধ্যে চলে আসছে ➡
"তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে,তাঁকে ছাড়া অন্য কারও 'ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়;তবে তাদেরকে 'উফ' শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না;আর তাদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বল।"
#বইটি_পড়ে_আমার_অনুভূতি :বইটি পড়ে সম্পাদকের মতো আমারও মা-বাবাকে দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে আছে।প্রতিটি গল্প পাঠের সময়ই আমার প্রাণপ্রিয় মায়ের মায়াবী অবয়ব ভেসে উঠেছে,ভেসে উঠেছে বাবার আত্মত্যাগী সেই মুখ।চোখের পানি অজান্তে গড়িয়ে পড়েছে বইয়ের পাতায়। প্রতিটা গল্প হৃদয়ে সাড়া জাগানোর মতো,আত্ম উপলব্ধি নিয়ে আসার মতো।বইটি পড়ার পর যে কেউ মা বাবার প্রতি পূর্বের থেকেও বেশি যত্নবান হবে বলে আমার বিশ্বাস। টিনএজদের সাজেস্ট করার জন্য অতি উত্তম বই। আমার সাধ্য থাকলে আমি এই বইটি গণহারে সবাইকে উপহার দিতাম।সবশেষে বলতে চাই আমার অতি প্রিয়, স্বার্থহীন বাবা-মা❤ যাদের মায়া,মমতা,আদর যত্নে এক নিখাঁদ ভালোবাসার ছোঁয়া পাই,যাদের জন্য আমার এ অস্তিত্ব,নিজেদের সবটুকু ঢেলে যাঁরা আমাকে বড় করেছেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে যাতে তাদের সাথে সর্বোত্তম আচরণ করতে পারি।তাঁদের সন্তুষ্টি নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারি মহান আল্লাহর নিকটে একান্তই আবেদন। মা-বাবা এবং সন্তানদের ভালোবাসার❤ চক্র সবসময়ই আবর্তিত হোক।
আপনার মন্তব্য লিখুন