
ঝিলাম নদীর দেশ
ঝিলাম নদীর দেশ
লেখক: বুলবুল সরওয়ার
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯০ খ্রি:
প্রথম প্রকাশক: সৃজন প্রকাশনী, ঢাকা
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স কর্তৃক দ্বিতীয় মুদ্রণ: ২০১৮ খ্রি
প্রচ্ছদ: জোহরা বেগম
মূল্য: ২৫০ টাকা
বইটি আমাকে সরবরাহ করেছেন: বইপাঠাই ডটকম
রিভিও লেখক: রুবি বিনতে মনোয়ার
সূচনা:
'ঝিলাম নদীর দেশ' বইটির প্রথম প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, 'প্রত্যেক কবি যেমন তার নিজস্ব নারী নির্মাণ করেন, ঝিলামও তাই'।
ঝিলাম এটি নদীর নাম, ঝিলাম নামটিই এমন যে শোনামাত্র, বুকের ভেতর কেমন কেমন একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমাদের জল যেমন ঝিলমিল ঝিলমিল করে, ঝিলামের জলও তেমন। কেমন একটা আত্মীয়তার বন্ধন অনুভূত হয়। দেখে নিই ঝিলাম সম্পর্কে উইকিপিডিয়া কী বলছে,
"বিতস্তা নদী বা ঝিলাম নদী, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পাঞ্জাবের পাঁচটি বড় নদীগুলোর মধ্যে ঝিলাম নদী একটি। এটি চেনব নদীর একটি উপনদী এবং এর দৈর্ঘ্য ৮১৩ কিলোমিটার । ঋগ্বেদে ঝিলাম নদীকে 'বিতস্তা' নদী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে অপরদিকে প্রাচীন গ্রীসে এই নদী হাইডাস্পি নামে পরিচীত ছিল। আর্যরা ঋগ্বেদে এই নদীকে অত্যন্ত পবিত্র নদী হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং ঋগ্বেদের অনেক জায়গায় সপ্তসিন্ধু নামে যে শব্দটি পাওয়া যায় ধারণা করা হয় যে, ঝিলাম নদী এই সপ্তসিন্ধুর মধ্যে একটি"।
ঝিলাম নদীর দেশ বইটি নিয়ে আলোচনা:
মোট ১৫টি শিরোনামে শুরু থেকে টান টান ভাব নিয়ে বইটি তর তর করে এগিয়ে গেছে সমাপ্তির দিকে। একেকটি শিরোনামের ভেতর যে লেখাগুলো তা অনেক তথ্য দেয়, অনেক ভাবনার জন্ম দেয় মনে। আমি আমার বয়ান তাই শিরোনাম ধরে ধরে সংক্ষেপে সেরে নিচ্ছি যাতে বইটি সম্পর্কে একটি ধারণার জন্ম নেয় পাঠকের মনে, রিভিউটি পড়ার পরে।
১। স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা
----------
শুরু হয়েছে আলবেরুণীর উদ্ধৃতি দিয়ে। কাশ্মিরের উদ্দেশ্যে কলকাতা ছাড়ার পর লেখকের বিরতিহীন ছেচল্লিশ ঘন্টা রেলভ্রমণের পর টুরিস্ট বাসে বসা, আবার রেল ভ্রমণ, তারপরই এসেছে বিস্বাদময় খাবারের কথাটি। লেখকের সাথে এক পর্যায়ে দেখা হয় কাশ্মিরী মুসলিম উচ্চ শিক্ষিত তরুণী নাজনীন এর, যার হাসিতে ছিল বিশ্বাসের চিহ্ন, লেখক যাকে এভাবে প্রকাশ করেছেন, "বিশ্বাসের আলাদা একটি ভূগোল আছে, যা রাজনৈতিক সীমানার চেয়ে বহু বিস্তৃত"। নাজনীন এর কাছ থেকে লেখক কাশ্মীর সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলেন, কাশ্মীর বার বার লুণ্ঠিত হয়েছে, এ তথ্য নাজনীন যখন বলছিল, লেখকের মনে তখন স্বদেশের ছবিটাই ভেসে ওঠেছিল। নাজনীন তাঁকে একটি হোটেলে নিয়ে যায় যেখানে লেখক তিনদিন পর ভাত খেতে পান। নাজনীন তার বাড়ি যাবে, তার মা তাকে ডেকেছেন হয়ত তার বিয়েও হয়ে যাবে, তবে লেখক নাজনীনের কাছ থেকে অনেক তথ্যই জানতে পান; মুঘল স্থাপত্য, ঝিলাম ও লিডার নদীর অপূর্ব হাতছানির কথা বলে নাজনীন অবশেষে চলে যায়।
২। ঝিলমিল করে ঝিলামের জল:
------
রবীন্দ্রনাথের ঝিলাম নিয়ে কবিতা দিয়ে শুরু এই পর্বে লেখক গাইডের সাথে ঝিলামের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করেন। লেখক মুসলিম জেনে গাইড আবেগাপ্লুত হয়, নাজনীনের মতই তার কণ্ঠে ফুটে নিজেদের মাতৃভূমির দুঃখগাঁথার সুর। ঝিলাম নদীতে নৌকার উপর আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত হোটেলের বর্ণনা, তাদের আতিথেয়তা সত্যিই মনকাড়া।
৩। তখৎ-ই-সুলায়মান:
আল মাহমুদের কবিতা দিয়ে শুরু এ পর্বে লেখক শংকারাচার্য মন্দির, পীর-পাহাড় দেখেন, এই পীর পাহাড়ের নাম ছিল আগে তখৎ-ই-সুলায়মান। এ পর্যায়ে গাইডের বন্ধু করিম খানের সাথে পরিচিত হন। লেখক নাজনীন, গাইড ও তার বন্ধু করিম খানের চিন্তার গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, " বেদুঈন আরব আর ধনকুবের শেখদের মধ্যে এত বিশাল নৈতিক দূরত্ব কেন? নাকি ক্রমাগত জুলুম, উৎপীড়ন, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-দুঃখই মানুষের আত্মিক সততাকে কলুষিত করে? কে জানে!"
৪। চেশমা শাহী:
জোশ মালিহাবাদীর উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু পর্বটিতে লেখকের সাথে রুদী নামক এক তুর্কী যুবকের সাথে দেখা হয়।
৫। প্রেম কানন:
ক্রিস্টোফার মার্লোর উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু এই পর্বে লেখকের সাথে এক কাশ্মিরী পরিবারের দেখা হয়, দেখা হয় মিসরীয় তরুণী তাবাসসুম এর সাথে। এই পর্বে শালিমার বাগ সম্পর্কে লেখক বলেছেন এটির নাম ছিল ফারাহ-বখশ বা আনন্দ-উদ্যান। কিন্তু সম্রাট সেলিম ও নূরজাহান একে শালিমার বাগ বা প্রেম-কানন বলে ডাকতেন।
৬। আতর-ই-জাহাঙ্গীরী
শাহজাদা সেলিমের বাণী যা আনার কলির সমাধিলিপিতে উৎকীর্ণ, তা দিয়ে এই পর্বের শুরু। এই পর্বে মুঘলদের রাজশক্তি ও পরাক্রমের পাশাপাশি তাদের শিল্প ও নন্দনচর্চার বিষয়টি এসেছে। রয়েছে আনার কলি ও নিশাত বাগের কথা এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখকের বিশ্লেষণ।
৭। আরেক নূরজাহান
মীর তকী মীর এর উদ্ধৃতি রয়েছে শুরুতে। কাশ্মীরের পর্যটন ব্যবস্থা সম্পর্কে এখানে জানা যায়। এখানে এক বৃদ্ধ ও তার পরিবারের সাথে পরিচয় হয়। যুবরাজ ইউসুফ ও জুনির প্রেমের কাহিনী বৃদ্ধের বয়ানে জানা যায় এ পর্বে। জুনি কবিতা লিখতেন, ইউসুফ শাহের সাথে তার বিয়ে হলেও জুনির মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের বিচ্ছেদ হয়। জুনির কবরে লেখা ছিল জুনিরই কবিতা, যা দেখে ইউসুফ শাহ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন।
এরপর রয়েছে একে একে
৮। পাহাড় ঘুমায় ঐ
৯। বাড়ির পাশে আরশীনগর
১০। সাদা মর্মরে বাঁধা
১১। চেয়ো না সুনয়না
১২। চিনারে আগুন জ্বলে
১৩। সবার কথা কইলে, এবার
১৪। কেটেছে রঙিন মখমল দিন
১৫। মুসাফির, মোছরে আঁখি জল
সবগুলো পর্ব থেকে কিছু কিছু লিখলেও লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে যায়।
শেষ পর্বে লেখকের সাথে নাজনীনের আবার দেখা হয়েছিল, সে তখন বিবাহিত তবে সেটা ছিল স্বপ্ন।
লেখকের পরিচয় ও আলোচ্য বইটি:
লেখক বুলবুল সরওয়ারের জন্ম ১৯৬২ সালের ২৭ নভেম্বর, গোপালগঞ্জে। তিনি ছিলেন জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির চর্চা, তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ২৬। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায়ই তাঁর ছিল বিচরণ। তিনি যেসকল পুরস্কার পান- পদ্মরাগ সাহিত্য সংঘ সম্মানা-২০১৫, সৈয়দ আলী আহসান সম্মাননা-২০১৬, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭।
ঝিলাম নদীর দেশ নামক ভ্রমণকাহিনীটি তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবস্থায় লিখেছিলেন। যার ৫০টি মুদ্রণ সংস্করণ নিঃশেষিত। স্বাদু গদ্যে লেখা তাঁর এই ভ্রমণকাহিনীটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক ক্লাসিক হয়ে ওঠেছে।
ভ্রমণকাহিনীর পাশাপাশি এতে ওঠে এসেছে ইতিহাস, বর্তমান। পাশাপাশি সমকালীন লেখকদের কথা, বিভিন্ন তথ্য, লেখকের নিজস্ব ভাবনা ও বিশ্লেষণ, দেশপ্রেম,মানব প্রেম সব মিলিয়ে একটি অনবদ্য রচনা। ঝিলাম নদীর দেশ বইটি না পড়লে বোঝা যাবে না বাংলা সাহিত্যের কী অমূল্য সংযোজন এটি।
পাঠশালার সৌজন্যে বইটি পড়া হল, আপনারাও পড়ে দেখুন।
আপনার মন্তব্য লিখুন