
আলব্যায়ার ক্যামুর প্রতীকী উপন্যাস 'দ্য প্লেগ'
আলব্যায়ার ক্যামুর প্রতীকী উপন্যাস 'দ্য প্লেগ'
ওরান শহড়ের প্রকৃতি বড় রুক্ষ আর প্রতিকূল। এখানে রাত নামে হঠাৎ করে। শহড়ের সবকিছুতেই যেন প্রাণহীনতার একটা ছাপ। গাছে লতা নেই, পাতার মর্মর শব্দ নেই, নেই পাখির কলকাকলি!ঋতু পরিবর্তন বোঝার জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নাই।
শহড়তলী থেকে ফেরিওয়ালারা ঝুড়িভর্তি ফুল নিয়ে আসলে বুঝতে হবে এখন বসন্ত!গ্রীষ্মে প্রচন্ড দাবদাহে বাড়ির দালান, রাস্তাঘাট সব শুকিয়ে ঠনঠনে হয়ে যায়! শরতে থাকে থিকথিকে কাঁদা।একমাত্র শীতে একটু অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যায়।
শহড়টার বর্ণনা দিতে গেলে আসলে এখানকার লোকেরা কী করে, কিভাবে ভালবাসে,আর কিভাবে মারা যায় তার বর্ণনা দিতে হবে!
এখানকার লোকজন কঠোর পরিশ্রম করে বড়লোক হওয়ার জন্য। জীবনের প্রধান লক্ষ্য এখানে বাণিজ্য। সারা সপ্তাহ পরিশ্রম করে শুধু রবিবার একটু অবসর ভোগ করে এখানকার বাসিন্দারা।
প্রয়োজনমাফিক অবসরের অভাবে এখানকার নর- নারীরা পরস্পরকে ভালোভাবে না জেনেই প্রেমে পড়ে, দ্রুত পরস্পরকে নিঃশেষ করে ফেলে! প্রয়োজনের তাগিদে এই প্রেম- ভালবাসাতেও তাদের তাড়াহুড়া!
মৃত্যর আগে তারা সবকিছু থেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অবধারিতভাবে।
এই শহড়েই হঠাৎ দেখা দেয় প্লেগ রোগের প্রাদূর্ভাব, পুরো শহড়ে সংক্রামক ছড়িয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ শহড়ের প্রধান ফটক আটকে দেয়, বাইরের জগত থেকে শহর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক বছর ধরে চলে প্লেগের সাথে এখানকার মানুষের যুদ্ধ।জীবন যুদ্ধে পরাস্ত হয় শহড়ের অগনিত বাসিন্দা, মৃত্য উপত্যকায় পরিণিত হয় ওরান শহড়।
এই হচ্ছে আলবেয়ার ক্যামুর বিখ্যাত উপন্যাস "দ্যা প্লেগ" এর প্লেগ আক্রান্ত ফরাসি বন্দর, আলজেরিয়ার ওরান শহড়।
আলবেয়ার ক্যামুর প্রতিকী উপন্যাস দ্যা প্লেগ। ওরান শহড়, শহড়ের বর্ণনা, প্লেগের আগমন সবকিছুই প্রতিকী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে ক্যামু সেখান থেকে পালাতে চেষ্টা করেন, পরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে সে ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। ক্যামুর ব্যক্তিগত জীবনের এই অংশটুকু বিচার করলে আমরা ওরান শহরকে ফ্রান্স, শহড়ের প্রানহীনতা, নির্মমতা বা রুক্ষতাকে পরাধীণতা আর প্লেগের আগমনকে স্বৈরাচারের উত্থান হিসাবে দেখতে পারি। এছাড়া ক্যামু জীবনের প্রথমদিকে কমিউনিজমের প্রতি অনুরাগী ছিলেন।ওরান শহড়ের মানুষের বড়লোক হওয়ার জন্য অবসরবিহীন কর্মব্যস্ততা ও বাণিজ্যকে পুঁজিবাদের খারাপ দিক হিসাবেও দেখিয়ে থাকতে পারেন।
উপন্যাসের চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করারর পূর্বে ক্যামুর ব্যক্তিগত জীবনের দিকে একটু ফিরে তাকালে চরিত্রগুলির উদ্দেশ্য বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে সুবিদা হবে।
ক্যামু ছিলেন আলজেরিয় দার্শনিক, লেখক, সাংবাদিক ও নাট্য সংঘঠক। সাহিত্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী। সাহিত্যিক, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও দখলদার জার্মান হামলার প্রতিবাদকারী। নিষিদ্ধ পত্রিকা ‘কোঁবা’–এর সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক
অনেক ধরনের পেশার সাথেই জড়িত ছিলেন , এর মধ্যে একটি হল তিনি আলজেরিয়ার জাতীয় দলের ফুটবলার ছিলেন।আলজেরিয়া ও ফ্রান্স দুই দেশেই ছিলো তার বাস।
১৯১৩ সালে আলজেরিয়ার মন্দোভিদে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এই বহুমুখী প্রতিভার সাহিত্যিক। ১৯৬০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর শৈশব কেটেছে দরিদ্রতার মাঝে। পড়াশোনা করেছেন দর্শন নিয়ে আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একজন টগবগে যুবক, তরুণ লেখক। ‘কোঁবা’ নামে একটি গুপ্ত পত্রিকার সম্পাদনা করতেন, ‘কোঁবা’র জন্য লেখা আর্টিকেল জোগাড়-যন্তের দায়িত্বে ছিলেন।আগেই উল্লেখ করেছি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিরা যখন ফ্রান্স দখল করে নেয়, ক্যামু সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে সে ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগদান করেন।
এবার ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের মেজর চরিত্রগুলোর দিকে তাকাই। তিনটি মেজর চরিত্র হলো; ডাক্তার বার্নার্ড রিও,জাঁ তারিও আর র্যাবেয়া।
১.ডাক্তার বার্নার্ড রিও:উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই চরিত্রটিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে ক্যামুর জীবনদর্শন সম্পর্কে একটু ধারণা নিলে সুবিদা হয়।এই উপন্যাসটির আলোচনা পড়তে গিয়ে যতটুকু জেনেছি ক্যামুর ছিল চিন্তার স্বচ্ছতা, গভীর মনোনিবেশ, জীবনের সূক্ষ্ণচেতনার বিন্যাস।তিনি ছিলেন মানবতাবাদী মানুষ। উপন্যাসের ডাক্তার রিওকে আমরা দেখি;তার শৈশব কাটে দারিদ্র্যের মাঝে।নিজের অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে দূরে রেখে প্লেগ আক্রান্তদের সেবায় ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, ও পরিস্থিতির সূক্ষ্ম ও গভীর পর্যবেক্ষণ আসলে ক্যামুর নিজেরই দর্শন।
২. জাঁ তারিউ:সক্রিয় কর্মী ছিলেন কিছু রাজনৈতিক আন্দোলনে। পর্যবেক্ষক ও নিয়মিত ডায়েরি লেখার অভ্যাস থেকে বিবিধ ঘটনা টুকে রাখেন।ক্যামু তার এক সাক্ষাতকারে নিজের লেখালেখির এই কৌশল সম্পর্কে বলেছিলেন।
৩. র্যঁ বেয়া: বড় শহরে সাংবাদিকতা করেন। তথ্য সংগ্রহ করতে এসে ওরানে আটকা পড়েন এবং সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন এবং সুযোগ পেয়েও সিদ্ধান্ত পাল্টে ওরান শহরের স্বেচ্ছাসেবীদের দলে যোগদান করেন। কিন্তু র্যঁ বেয়ার মন পড়ে থাকে অন্য শহরে, তাঁর প্রেমিকার কাছে। ঠিক ক্যামু যেমন তাঁর সব লেখাতেই আলজেরিয়াকে রেখেছেন, ফ্রান্সে বাস করেও তাঁর মন সারাক্ষণ আলজেরিয়াতেই ছিল যেন।
এই তিনটি চরিত্রের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আলবেয়ার ক্যামুর বাস্তব জীবনের ঘটনাই বলে দেয় পাঠকদের।
ক্যামুর রাজনৈতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির আরো একটি দৃষ্টান্ত উপন্যাসের একেবারে শেষের দিকে দেখতে পাই ডাক্তার রিওয়ের একটি বক্তব্যের মাধ্যমে।
ডাক্তার রিও জানান যে "যে- রোগ মৃত্যুগন্ধী তা নাকি কোনোদিন একেবারে নিশ্চিহ্ন হয় না। কোথাও-না-কোথাও কোনো-না-কোনোভাব নিজেদের জিইয়ে রাখে। এ হচ্ছে মৃত্যুবীজ, যা যুগ যুগ ধরে জীবিত থাকে।" এই যে বীজের ইঙ্গিত দেওয়া হলো, এটা আসলে প্রচলিত কোনো রোগের বীজ মনে হয় না, এ হচ্ছে রূপক,স্বৈরাচারের রূপক, ফ্যাসিজমের রূপক। তাই আমরা দেখি, হিটলারের স্বৈরতন্ত্রের বীজই কখনো রাজতন্ত্র রূপে, কখনো সামরিক শাসনের নামে, কখনো সংসদীয় শাসনের বেশে রাষ্ট্রীয় জীবনে ঘুরেফিরে আসে। এটি একটি চক্র। এর বীজ রোপীত হয়েছিলো, এখনো বিশ্বের অনেক জায়গাতেই আছে, হয়তো সাময়িকের জন্য চলে যাবে। তবে আবারও আসবে।
আপনার মন্তব্য লিখুন